![]() |
নিবারণ বড়ুয়া : স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | কাছেদূরে ডটকম ঘটনা-১: শুক্রবার সন্ধ্যার আগে। হাঁটছিলাম ডিসি হিলে। মুল গেইট থেকে প্রবেশ করতেই হাতের ডান
দিকে একদল ভবঘুরে গোল করে বসে আছে। সাথে কয়েকজন মহিলা, তারা শুয়ে আছে। কাছে গেলাম। লক্ষ্য
করলাম গাঁজার আসর। কলকিতে ভরে টানছে। ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন, বিশ্রী গন্ধ। তাদের পাশে আরেকদল
বসে আছে। সেই দলে বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ। তারা অপেক্ষা করছে ছেলেপক্ষের জন্য। তার মানে ঘটকালির ব্যাপার।
ডিসি হিলের গোল চত্বরটা ক্রস করেই পূর্বদিকে যেতে দেখা মেলে এক দল তৃতীয় লিঙ্গের।
তারা এক হতভাগা প্রেমিক-প্রেমিকাকে ঘিরে ধরে অশ্লীল আচরণ করছে। বেশ আয়েশ করে মজাও করছে।
তাদের কাছে চাওয়া হয়েছে মাত্র ৫০০ টাকা। তার মানে বেশ আয়েশ করে চাঁদা তুলছে। ঘটনা-২: শনিবার বেলা ১২ টা। ডিসি হিলের সিমেন্টে তৈরী বসার চেয়ারগুলোতে কোথাও
খালি নেই। জোড়ায় জোড়ায় বসে আছে স্কুল-কলেজ পড়–য়া ছেলে-মেয়েরা। জমিয়ে প্রেম চলছে স্কুলটাইমে। গাছের আড়ালে বা একটু
নিরিবিলি স্থানে অপ্রাপ্ত বয়স্ক প্রেমিক যুগলের সংখ্যা বেশি। তবে বিব্রতকর
পরিস্থিতিতে। নজরুল চত্বর বা স্কোয়ারের পাশে একদল কম বয়সী বখাটে যুবকের আড্ডা
চলছে। চোখে সান গ্লাস, ঠোঁটে সিগারেট।
আর পোষাকের বাহার সে তো বড়ই সৌন্দর্য। তারা মেয়েদের লক্ষ
করে নানা টিপ্পুনি দিচ্ছে। আর সিগারেটের ধোঁয়ায়
মুখ দিয়ে রিং বানাচ্ছে। ঘটনা -৩: গত বুধবার সকাল সাড়ে ৮ টা। একদল যুবক ফুটবল খেলছে ডিসি হিল মুক্ত
মঞ্চের ছোট মাঠে। এক পাশে শরীর চর্চা করছে কিছু ভদ্র মহিলা। তারা সেই মাঠ দিয়ে হেঁটে যেতে চাইলে
এক খেলোয়াড় তেড়ে আসে। নিষেধ করে দেয় খেলার সময় হাঁটা যাবে না। এমনকি খেলার সময় শরীর
চর্চাকারীদের গায়ে বল লাগে। অনেকে আহত হন। এদের কারণে ছোট বাচ্চারা খেলতে পারে না।
এর প্রতিকার তো নেই। বরং প্রতিবাদ করতে গেলে অপমানিত ,অপদস্থ হতে হয়। শুধু তাই নয়। মুল ফটকের সাথে চেয়ার দিয়ে বসে
আছেন খাকি রংয়ের ড্রেস পড়া এক যুবক। চেয়ারে পায়ের উপর পা তুলে দিয়ে টেনে যাচ্ছেন
একের পর এক সিগারেট। তার কাছে এসে এসে হাজিরা দিচ্ছে বাদাম,বুট, রং চা , ঝাল মুড়ি বিক্রেতারা। এক ঝাল মুড়ি বিক্রেতার কাছে জানলাম, প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে ডিসি হিলের ভিতরে কোন কিছু
বিক্রি করা । তাই গেইটের পাহাদারের সাথে চুক্তি করছে। ভিতরে যেন যে কোন সময়ে
বিক্রি করা যায়। এর বিনিময়ে তাকে মাসিক ভিত্তিতে দিতে হচ্ছে দু একশত টাকা। জানা যায়, বছর খানিক আগে বিভিন্ন দিনে ডিসি
হিলে দিনব্যাপি বা সন্ধ্যায় নানা অনুষ্ঠান হতো। তবে কিছু নিম্নমানের অনুষ্ঠান যে হতো না তা
কিন্তু নয়; তার মানে অশ্লীল কিছু নয়। চট্টগ্রাম শহরের মুক্তমনা মানুষগুলো ছুটে যেতো ডিসি
হিলে নয় তো শিল্পকলায় একটু বুকভরে নিশ্বাস নিতে। কখনো রুচির বাইরে ব্যতিক্রম কোন
কিছু হলেও তা পুষিয়ে নেওয়া যেত। বাংলাদেশের সচেতন মানুষের চিন্তায় বা মগজে
চট্টগ্রামের ডিসি হিল মানে সাংস্কৃতিক একটি অঙ্গন হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে। এখানে
বর্ষবরণ ,
বসন্ত উৎসব ,পৌষ উৎসব, পিঠা উৎসব, নবান্ন উৎসব মানুষের হৃদয়ে নুতুন প্রেরণার সঞ্চার করে। উৎসবের বাইরেও বিভিন্ন
সংগঠনের সাংস্কৃতিক আয়োজন, বই মেলা, কবিতা উৎসব চট্টগ্রামকে সমৃদ্ধ করেছে। এ ধরনের চর্চা
কেন্দ্র বা বিশাল প্লাটফরমে গান পরিবেশন করার পরিবেশ থাকায় চট্টগ্রামের শত শত গুণীশিল্পী ঢাকার
সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও সুনাম কুড়িয়েছে বেশ। দেশের প্রথম সারির অধিকাংশ শিল্পীই
চট্টগ্রামের। এখানে প্রায় ৪ দশকেরও বেশি সময় ধরে সুস্থ ধারার সংস্কৃতি চর্চা ও
বাঙালি ঐতিহ্যের নানা অনুষ্ঠান উদযাপিত হয়ে আসছে। এর ফলে চট্টগ্রামের ডিসি হিল
মানেই বিভাগীয় কমিশনারের বাসভবন এবং কমিশনারের বাসভবন হিসেবে কম মানুষেই জানে।
কারণ দীর্ঘ সময়ে ডিসি হিল, মুসলিম হল, শহীদ মিনারকে ঘিরে যে ভাবে সাংস্কৃতিক বলয় তৈরী হয়েছে সেই
ইমেজটি মানুষে মগজে জায়গা নিয়েছে। এখন মানুষের মনে ডিসি হিল মানেই এখানে রুচিশীল অনুষ্ঠান হবে, এখানে গ্রাম বাংলার বিভিন্ন ঋতুর আগমনে বড় বড় উৎসব হবে। এর
বাইরে নতুন ভাবে কোন কিছু করতে চিন্তা করা বা বাধা দেওয়া সেটা চট্টগ্রামের চলমান
ইতিহাসের জন্য কলংকজনক এবং নিজের পায়ে কুড়াল মারা সমান। বেশ কয়েকদিন ধরে সমালোচনার
ঝড় উঠেছে বিষয়টি নিয়ে। নিরাপত্তার অজুহাতে চট্টগ্রামের ডিসি হিলে সংস্কৃতি চর্চা
বন্ধ করে দিয়েছে চট্টগ্রামে জেলা প্রশাসক। এ নিয়ে চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক অঙ্গন
এবং সংস্কৃতিসেবীদের মাঝে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে। তবে এর প্রতিবাদে তীব্র নিন্দা
জানিয়েছে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট চট্টগ্রাম। সংগঠনের সভাপতি অধ্যাপক ড. অনুপম সেন
ও সাধারণ সম্পাদক নাট্যজন আহমদ ইকবাল হায়দার এক বিবৃতিতে বলেছেন- চট্টগ্রামে
সংস্কৃতি চর্চার অন্যতম প্রাণকেন্দ্র ডিসি হিল মুক্তমঞ্চ। এই মুক্তমঞ্চটি সকলের
কাছে বর্তমানে নজরুল স্কয়ার নামে পরিচিত। এখানে সংস্কৃতিচর্চার দীর্ঘ ঐতিহ্য
রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো এই মুক্তমঞ্চে
নিয়মিতভাবে সুস্থ সংস্কৃতিচর্চা তথা সাংস্কৃতিক উৎসব, বিজয় উৎসব, পথ নাটক, আবৃত্তি অনুষ্ঠান, নৃত্য অনুষ্ঠান, সঙ্গীত অনুষ্ঠান
প্রভৃতি মঞ্চস্থ করে থাকে। এই আয়োজনগুলো অসাম্প্রদায়িক বাঙালি সাংস্কৃতিক ধারাকে
এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে অসাধারণ ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে চলেছে। বর্তমান
সংস্কৃতিবান্ধব সরকার জঙ্গিবাদকে প্রতিহত করার জন্য সংস্কৃতিচর্চাকে বেগবান করার
বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। তাঁরা বিবৃতির মূল কথা বলেছেন, চট্টগ্রাম ডিসি হলে সংস্কৃতিচর্চা বন্ধের যে অনাকাক্ষিত ও অকাম্য সিদ্ধান্ত
বর্তমান স্থানীয় প্রশাসন গ্রহণ করেছেন তা পক্ষান্তরে জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীর উত্থানকেই
ত্বরান্বিত করবে বলে আমরা আশংকা করছি। এই সিদ্ধান্ত সরকারের গৃহীত সংস্কৃতিচর্চাকে
বেগবান করার কর্মসূচীকে বিরাটভাবে ব্যাহত করবে। বাধার সৃষ্টি করবে। যতদুর জেনেছি, বিগত সময়ে ডিসি
হিলের মুক্তমঞ্চে একেটি অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য অনুমতির পাশাপাশি চট্টগ্রাম জেলা
প্রশাসনকে সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে দুই হাজার টাকা করে ভাড়া বাবদ দিতে হতো। ডিসি
হিলের আলোক ব্যবস্থা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজটি নিয়মিতভাবেই চট্টগ্রাম সিটি
কর্পোরেশন করে এসেছে। ডিসি হিল মুক্তমঞ্চটি মূলত সরকারের জায়গা। গত এপ্রিল থেকে এই মঞ্চের ভাড়া ২ হাজার টাকা থেকে ৫ গুণ বৃদ্ধি করা
হয়েছে। সাংস্কৃতিক সংগঠন ও সংস্কৃতিকর্মীদের সঙ্গে কোন ধরনের আলোচনা ছাড়াই
সাংস্কৃতিকচর্চার প্রাণকেন্দ্র ডিসি হিলের ভাড়া বাড়নোর সিদ্ধান্তে ক্ষোভ প্রকাশ
করেছেন চট্টগ্রামের সংস্কৃতিকর্মীরা। কোন অজুহাতেই ডিসি হিলের ভাড়া বাড়ানো মেনে
নেবে না বলে জানিয়েছেন তারা। প্রগতিশীল মুক্তবুদ্ধি চর্চার মানুষরা মনেকরে বিভিন্ন
কৌশল প্রয়োগ করে ধাপে ধাপে ডিসি হিলের ৪ দশকের কর্মকান্ড সংকুচিত করা হচ্ছে। সংস্কৃতিকর্মীদের ভাষ্য, ৩৯ বছর আগে
পহেলা বৈশাথ উদযাপনের মধ্য দিয়ে ডিসি হিলে প্রথম অনুষ্ঠানের সূচনা হয়েছিল। সেই
থেকে ডিসি হিল চট্টগ্রামের সংস্কৃতি অঙ্গনের প্রাণকেন্দ্র। পরবর্তীতে চট্টগ্রামের
শিল্পী,
সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদদের
দাবির প্রেক্ষিতে ডিসি হিলে সংস্কারকাজ করা হয়। সংস্কৃতিচর্চার জন্য নির্মিত হয় বড়
মঞ্চ ও গ্যালারী।
একটি দেশের মানুষ সভ্য বা সুস্থ চিন্তা ধারায় আনতে হলে সাংস্কৃতিক চর্চা
জরুরী। এর মাধ্যমে মানুষের জীবন বোধ, চিন্তা-চেতনার বিশালতা বাড়ে। আমরা
চট্টগ্রামের সর্বস্থরের মানুষের পক্ষে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনকে আহ্বান জানাই ডিসি
হিল যে আগের চেহারায় ফিরে আসে। আমরা চাই না এটা অশ্লীলতা বা বখাটেদের আতুড় ঘরে পরিণত হউক।